লক্ষ্মীপুরের আদালতে একটি জামিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন বিচারকের আদালত বর্জন করেছেন আইনজীবীরা। এ সময় আইনজীবীদের সঙ্গে আদালতের কর্মচারীদের হাতাহাতি ও এজলাসে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷
রক্তাক্ত আহত হয়েছেন ওই এজলাসের স্টেনোগ্রাফার আশরাফুজ্জামান৷
আজ রোববার (১৫ জুন) দুপুর ০১ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আদালত বর্জন করায় ভোগান্তিতে পড়েন বিচারপ্রার্থীরা।
জানা গেছে, গত ৬ জুন সদর থানায় রায়পুর প্রিন্সিপাল কাজী ফারুকী স্কুল এণ্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আহমেদ কাউসার উদ্দিন জামানের (৩৫) বিরুদ্ধে চুরির মামলা করেন তারই প্রতিবেশি জেলা জজ আদালতের আইনজীবী আবু তৈয়ব।
মামলায় আরও দুইজনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় আসামি কাউসার ও রুবেল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন।
এরপর গত ১০ জুন সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এর বিচারক এম সাইফুল ইসলাম তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। এ নিয়ে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ আইনজীবীরা।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, বাদী এবং আসামিদের মধ্যে পূর্ব বিরোধ রয়েছে। ৫ জুন দিবাগত গভীর রাতে আসামিরা পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বাদীর ভবনের সামনে থাকা একটি লোহার গেট কেটে নিয়ে এবং গেটের পিলার ভেঙে একটি পিক-আপ গাড়িতে করে রায়পুরের দিকে নিয়ে যায়। রায়পুর বাসাবাড়ি এলাকায় গেলে পিক-আপ গাড়িটি টহল পুলিশ আটক করে। পরে চালক রুবেলকে আটক ও গাড়িটি জব্দ করে পুলিশ। মামলায় বাদী আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি উল্লেখ করেন।
আদালত সূত্র জানায়, গত ৯ জুন আসামিদের জামিন প্রার্থনা হয়। এতে আসামিপক্ষ উল্লেখ করেন, মামলার বাদি আইনজীবী হওয়ায় আদালতে তাদের পক্ষে কোন আইনজীবী জামিন শুনানিতে অংশ নিতে ইচ্ছুক নয়। আসামিরা তাদের পক্ষে আইনজীবী না পেয়ে জামিন শুনানির জন্য লক্ষ্মীপুর লিগ্যাল এইড অফিসে আইনী সহায়তা চান। সেখান থেকে দুইজন আইনজীবীকে শুনানি করতে বলা হলেও তারা হেনস্তার ভয়ে জামিন শুনানিতে অংশ নেননি।
অন্যদিকে বাদী পক্ষের আইনজীবী আসামিদের বিরুদ্ধে জামিনের বিরোধিতা করেন।
আদালত সূত্র আরও জানায়, আসামিরা ৯ জুন জামিনের জন্য আবেদন করলে পরদিন ১০ জনু নথি প্রাপ্ত সাপেক্ষে জামিন শুনানির জন্য রাখা হয় এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।
বিষয়টি নিয়ে আদালতের পর্যালোচনায় উঠে আসে, ঈদুল আজহার বন্ধে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এবং গ্রেপ্তারের পর থেকে আসামিরা জামিনের শুনানির সুযোগ পাননি। চারদিন তাদের হাজতবাস হয়েছে। ৬ জুন আসামি গ্রেপ্তার হলেও বাদী একজন আইনজীবী হওয়ায় আসামিরা জামিন শুনানির জন্য কোন আইনজীবী পাননি। লিগ্যাল এইড অফিসের আইনজীবীরাও শুনানিতে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ায় ১৪ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটিতে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় জামিন অযোগ্য ধারায় গুরুতর অভিযোগ না থাকায় উভয় পক্ষের শুনানি অন্তে উভয় দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়।
আদালত আসামিদের রিমান্ড না মঞ্জুর করে চারদিনের হাজতবাস ও ঈদ বিবেচনা করে আসামি কাউসার ও রুবেলকে ১০০ টাকা বন্ডে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির জিম্মায় জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিন হওয়ায় পর থেকেই আইনজীবীদের ক্ষোভ বিরাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেজবুকে পোস্ট করে তারা বিচারকের অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
ঈদের বন্ধ শেষে আজ রোববার (১৫ জুন) আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। আইনজীবী সমিতি বৈঠক করে ওই আদালতের বিচারক এম সাইফুল ইসলামের আদালতের বর্জনের ঘোষণা দেন। এদিন সকাল থেকে ওই বিচারকের কক্ষে বিচারপ্রার্থীরা এসে উপস্থিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বিচারপ্রার্থী জানান, আদালতের বিচারক এজলাসে বসা ছিলেন৷ এ সময় ৭-৮ জন আইনজীবী কক্ষে ঢুকে আদালত বর্জনের ঘোষণা দেন।
এতে হট্টগোল দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিচারক আদালত কর্মচারীদের দরজা বন্ধ করে দিতে বলেন। এসময় আইনজীবী এ কর্মচারীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
রক্তাক্ত আহত হয় এজলাসের স্টেনোগ্রাফার আশরাফুজ্জামান৷ বিচারকার্য সম্পন্ন না করেই এজলাস থেকে নেমে যান বিচারক।
আহত আশরাফুজ্জামান বলেন, আইনজীবীরা হট্টগোল করায় বিচারকের নির্দেশে আমি দরজা বন্ধ করতে গেলে আমার উপর আইনজীবীরা হামলা করে। এতে আমার বাম চোখের পাশে রক্তাক্ত জখম হয়।
তবে উপস্থিত আইনজীবীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট আশিকুর রহমান জানান, কয়েকজন আইনজীবী এজলাসে গিয়ে আদালত বর্জনের বিষয়টি জানিয়ে দিতে গিয়েছেন৷ আদালত কর্মচারীরা উল্টো তাদের উপর হামলা করেছে। এতে তিনি নিজেও আহত হন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. রফিক উল্যাহ বলেন, আইনজীবী আবু তৈয়বের বাসার গেট কেটে চুরি করে নিয়ে গেছে আসামিরা।
তাদেরকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রিমান্ডের আবেদন করেন। আসামি পক্ষেও একজন আইনজীবী শুনানিতে ছিল। বিচারক রিমান্ড শুনানি নামঞ্জুর করে মাত্র ১০০ টাকা বন্ডে জামিন মঞ্জুর করেন। তাড়াহুড়ো করে আসামিদের জামিন দেওয়াটা অন্য অর্থ বহন করে।
আমরা জামিনের বিরোধিতা করলে সেটা আমলে নেয়নি বিচারক। আমরা মনে করি, বাদি একজন আইনজীবী হওয়ায় ন্যায় বিচার পায়নি।তাই বিষয়টি আমরা জেলা জজসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি এবং ওই বিচারকের আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রোববার আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে শুধুমাত্র এজলাসে গিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিই।সেখানে কোন হট্টগোল বা হামলার বিষয়টি আমরা জানিও না।
আপনার মতামত লিখুন :