সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সুইদা প্রদেশে দ্রুজ মিলিশিয়া যোদ্ধা ও সুন্নি বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো সংঘর্ষ হয়েছে। চলমান এই সাম্প্রদায়িক সংঘাতে সুইদায় অন্তত ৮৯ জন নিহত হয়েছেন বলে সোমবার দেশটির একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিয়েছে।
সুইদা প্রদেশে কিছুদিন ধরেই দ্রুজ মিলিশিয়া ও সুন্নি বেদুইন উপজাতিদের মাঝে উত্তেজনা চলছে। এর আগে সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুজদের রক্ষায় সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করার বিষয়েও সতর্ক করে দিয়েছিল ইসরায়েল। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী কয়েকটি ট্যাঙ্কে হামলা চালিয়েছে বলেও দাবি করেছে। তবে এই হামলার বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য দেয়নি ইসরায়েল।
সিরিয়ায় এই সহিংসতা দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন নেতা আহমাদ আল-শারার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে আল-শারা নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী বাহিনীর তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটে। আসাদের পতনের পর টানা ১৪ বছরের সহিংসতায় বিপর্যস্ত দেশটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।
সিরিয়ার সেনাবাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই এলাকায় সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য নিরাপদ করিডোর ও ‘‘দ্রুত ও শক্তভাবে’’ সংঘর্ষ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
রোববার দেশটির রাজধানী দামেস্কের একটি সড়কে দ্রুজ গোষ্ঠীর এক সবজি বিক্রেতা অপহরণের শিকার হন। এর পরপরই সেখানে পাল্টা অপহরণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে অপহৃতদের মুক্তি দেওয়া হলেও সোমবার সুইদা শহরের বাইরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সোয়াইদা২৪ বলেছে, উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি মর্টার হামলায় আশপাশে কয়েকটি গ্রামে বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির একজন আলোকচিত্রী ঘটনাস্থল থেকে বলেছেন, সুইদার রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য। জানাজার সময়ও সেখানে গুলির শব্দ শোনা গেছে।
সুইদার বাসিন্দা ৫১ বছর বয়সী আবু তাইম বলেন, ‘‘আমরা চরম আতঙ্কিত। এখানে নির্বিচারে কামানের গোলা ছোড়া হচ্ছে। সড়কে যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। অধিকাংশ দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে।’’
সোয়াইদা২৪ বলেছে, প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সংঘর্ষ ও গ্রামাঞ্চলে কামানের গোলাবর্ষণে অনেকে আহত হয়েছেন। কয়েক ডজন মানুষকে উদ্ধারের পর স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সুইদা প্রদেশে দুই গোষ্ঠীর এই সংঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৮৯ জনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাট। নিহতদের ৪৬ জন দ্রুজ, ৪ জন বেসামরিক, ১৮ জন বেদুইন ও ৭ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি রয়েছেন। এই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের শরীরে সামরিক পোশাক ছিল।
দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেলকে আল-এখবারিয়াকে বলেছে, সুইদায় সংঘাত অবসানের অভিযানে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ছয় সদস্য নিহত হয়েছেন।
রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস খাত্তাব বলেন, ‘‘রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, সামরিক বাহিনী ও নিরাপত্তা কাঠামোর অনুপস্থিতিই সুইদায় চলমান উত্তেজনার প্রধান কারণ।’’
‘‘সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে এই কাঠামোগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করা; যাতে নাগরিক শান্তি নিশ্চিত হয়।’’
এর আগে, গত এপ্রিল ও মে মাসে সিরিয়ার এই প্রদেশে দ্রুজ যোদ্ধা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই প্রদেশটিতে নতুন করে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের শুরু হয়েছে।
পর্যবেক্ষক সংস্থা দ্য অবজারভেটরি বলেছে, সিরিয়ায় এর আগের সংঘাতের সময় সুন্নিপন্থী বেদুইনদের একাংশ নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেই সময় উত্তেজনা প্রশমনে স্থানীয় নেতা ও ধর্মীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা উভয়পক্ষের মাঝে একটি চুক্তির ব্যবস্থা করেন। এই চুক্তির ফলে মে মাস থেকে সুইদার নিরাপত্তার দায়িত্ব দ্রুজ যোদ্ধাদের ওপর দেওয়া হয়। তবে এখনও কিছু এলাকায় বেদুইন উপজাতির যোদ্ধারা সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছেন।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে দ্রুজ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ লাখ; যাদের বেশিরভাগই দীর্ঘদিন ধরে সুইদা প্রদেশে বসবাস করে আসছেন। দ্রুজরা শিয়া ইসলাম থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া গোপন একটি ধর্মীয় পথ মেনে চলেন। আর এই সম্প্রদায়ের বসবাস প্রধানত সিরিয়া, লেবানন ও ইসরায়েলে।
সুইদায় বেদুইন ও দ্রুজদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। প্রায়ই এই দুই সম্প্রদায়ের মাঝে সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
গত মার্চে আলাউইত সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশানা করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় ১ হাজার ৭০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই সহিংসতার পর দ্রুজ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে হামলা শুরু হয়। এর ফলে দেশটির ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়।
এসব ঘটনার পর ইসরায়েল বলেছে, তারা দ্রুজদের নিরাপত্তায় সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক হামলা চালিয়েছে। এমনকি মে মাসের শুরুর দিকে দামেস্কের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছেও হামলার দাবি করে ইসরায়েল।
হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার ৫২ হাজার দ্রুজের বসবাস রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ২৪ হাজার দ্রুজ দখলকৃত গোলান মালভূমিতে বসবাস করেন। আর এই দ্রুজদের ৫ শতাংশেরও কম ইসরায়েলের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।
সূত্র: এএফপি।
আপনার মতামত লিখুন :