ঢাকা শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্তলোকে থাকুন ‘মিয়া ভাই’

ভোরের মালঞ্চ | কামরুজ্জামান বাবু মে ১৯, ২০২৩, ০৫:১৯ পিএম অনন্তলোকে থাকুন ‘মিয়া ভাই’

ঢাকাই সিনেমার যে কজনার নাম শুনলে শ্রদ্ধায় আর সম্মানে মানুষ অকুণ্ঠ ভালোবাসা দেখাতো তারা একে একে চলে যাচ্ছেন। না ফেরার দেশে যাওয়ার তালিকায় এতদিন ছিলেন জসিমআনোয়ার হোসেনহুমায়ুন ফরীদিরাজ্জাকএটিএম শামসুজ্জামানকবরী ও ওয়াসিম। এদের পরে মানুষ যাদের শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তারা হলেন—আলমগীর-সোহেল রানা-ফারুক-শাবানা-ববিতা। তাদের মধ্যে ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত ফারুকও চলে গেলেন না ফেরার (১৫ মে ২০২৩) দেশে।

 

অনেকদিন যাবৎ ফারুক শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন। সবাই আশায় ছিলেনউন্নত চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু আচমকা দুঃসংবাদ এলোরূপালি পর্দার এই নায়ক রোগের কাছে হেরে গেছেন। মৃত্যুকে বরণ করেছেন।

 

শক্তিমান এই অভিনেতাকে আমি বা চলচ্চিত্রের প্রায় সবাই মিয়া ভাই বলে ডাকতেন। নামটিতে ছিল সাংঘাতিক জাদু। এই নামে ডেকে তাকে কতবার যে অশান্ত থেকে শান্ত হতে দেখেছি!

 

মিয়া ভাই কেমন মানুষ ছিলেন?

অভিনেতা হিসেবে ফারুকের মূল্যায়ন করা আমার মতো ছোট মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তাকে দীর্ঘসময় কাছ থেকে যতটুক দেখেছি সেই বিবেচনায় অবলীলায় বলতে পারি তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার অন্তপ্রাণ।

 

৯৭-৯৮ সালের কথা। সকাল ৭টা বলেন আর ১০টা বলেনতার উত্তরার বাসায় যখনই যেতামতার বসার ঘরটিতে থাকতো মানুষ আর মানুষ। তার গ্রামের মানুষ। একেকজনের একেক রকম সমস্যা। তিনি মন দিয়ে শোনেন। জ্বলন্ত সিগারেটের ছাই অ্যাশট্রেতে রেখে একটা করে সমাধান করছেন। 

 

থানার ওসিকে বলতে হবেফোন করছেন। ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে বলতে হবেফোন করছেন। মেয়ের বিয়ে-অর্থ সাহায্য প্রয়োজনতাও করছেন। চোখে মুখে কোনো বিরিক্তর ছাপ নেই। সবাইকে বিদায় করে বলতেনআইছো? বহো। নাস্তাপানি খাও। আমি গোসল দিয়ে রেডি হয়ে আসি।’ আন্তরিকতায় মন ভরে যায়। কখনো সাদা পাঞ্জাবি-পাজামায়আবার কখনো সুটেড-বুটেড হয়ে ফারুক ভাই সাক্ষাৎকারে বসতেন।

 

এই তো মনে হচ্ছে সেদিনকার কথাতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মাথার চুল এখনো এত কালো! ঘুটঘুটে আঁধারের মতো যেন! মিয়াভাই কী আশ্চর্যচুলে কি কলপ দেন? চুল তো দেখি আপনার একটাও পাকেনি!

 

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিয়া ভাই সিগারেট জ্বালিয়ে লম্বা করে একটা টান দেন। ধোয়া ছেড়ে বললেনসবই ওপরওয়ালার দয়া। কোনোদিন তেলকলপকিচ্ছু দেই নাই। সময়মতো ঘুমাইটেনশন কম করি। আর টেনশন করেই বা কী লাভ? জীবন তো একটাই।’

 

সত্যিই ফারুক ভাই, আপনি যথার্থ বলেছিলেন। একজীবনে আপনি যা রেখে গেলেনতা অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের স্মৃতিতে।

 

জন্মেছিলেন গ্রামে। বেড়ে উঠেছেন শহরে। বিশ্বাসী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে। ১৯৭১-এর রণাঙ্গনের কথা বলতে বললেঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মৃতিচারণ করে গেছেন। একদিন জানতে চাইলামমিয়া ভাই ধরেন আপনি সিনেমায় অভিনয় যদি না করতেনতাহলে কী হতেন?

 

উত্তর শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বলেছিলেনহয়তো আমার লাশও পাওয়া যেত না।’

 

তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক জীবন যোদ্ধা। জন্ম গ্রামে হলেও বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়। ছিলেন জেদি ও একরোখা। পাড়া মহল্লায় হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানো এই মানুষটি নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর মঞ্চ নাটকে ফারুককে দেখে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন।

 

ফারুক প্রস্তাব নিলেন। ‘জলছবি (১৯৭১)’ নামে সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। নিজের জাত চেনালেন খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী (১৯৭৫)’ সিনেমা দিয়ে। রূপালি পর্দার ফারুক রূপেই পরিচিতি পেলেন। 

 

কোথাও অন্যায়-অনাচার দেখলে প্রতিবাদ করতেন। ন্যায়ের প্রশ্নে কোনো আপস ছিল না তার। তাই একের পর এক দুষ্টচক্রের চক্ষুশূলে পরিণত হন। কিন্তু আকবর খান পাঠানকে টেক্কা দেওয়ার সাহস কার?

 

অভিনয় শিল্পী ফারুক

‘সুজন সখী (১৯৭৫)’-এর পরে ফারুকের অভিনয়জীবনে একে একে যত সিনেমা এলোএর বেশিরভাগই গ্রামীণ পটভূমির। পাশাপাশি শহুরে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ছবিতেও সাফল্য পেয়ে যান। ‘নয়নমনি (১৯৭৬)’সারেং বৌ (১৯৭৮)’মিয়া ভাই (১৯৯০)’লাঠিয়াল (১৯৭৫)’পালকি (১৯৯০)’গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)’ একেকটি ছবি তো নয় যেন ৬৮ হাজার গ্রাম বাংলার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠা জীবন্ত এক ক্যানভাস।

 

তাকে যতদূর দেখেছিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। তার অভিনয় জীবনের গল্পের শুরু আছে কোনো সমাপ্তি নেই।

 

গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮)’ সিনেমার আড়াই মিনিট, সেই দৃশ্যের কথা মনে আছে তো? আমি ঠিক জানি না এই দৃশ্যে অভিনয় করার মতো আর কোনো শিল্পী সেই সময় নির্মাতা আমজাদ হোসেন পেতেন কি না। কিন্তু ফারুককে তিনি ঠিকই পেয়েছিলেন।

 

প্রতিবাদী যুবক অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে বিষপান করানো হয়। বিষপানের যন্ত্রণা ক্যামেরার সামনে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেনসেই দৃশ্য দেখে সিনেমা হলের ভেতরে চোখ মোছেননি এমন কোনো দর্শক তখন পাওয়া যায়নি।

 

সারেং বৌ (১৯৭৮)’ সিনেমার কথা মনে আছে? ফারুকের ঠোঁটে ‘ওরে ও নীল দরিয়া’ গানটি সিনেমায় দৃশ্যায়নে এলোসেই গানটি এখনো চির সবুজ গান হয়ে আছে। সারেং চরিত্রে এমনভাবে অভিনয় করলো ফারুক যেন‘সুজন সখী (১৯৭৫)’-র সুজনের সাথে এই সারেংয়ের কোনো মিলই ছিল না। না অভিনয়ে না গেটাপে।

 

‘নয়নমনি (১৯৭৬)’-র কথা যদি বলি ‘চুল ধইরো না খোঁপা খুলে যাবে হে নাগর’ এই গানে ববিতাকে সঙ্গে নিয়ে যে অভিব্যক্তি দেখালেনতা আজও রূপালি পর্দায় সেরা কয়েকটি দৃশ্যায়নের একটি।

 

এমন অভিনেতার কি মৃত্যু আছে? হয়তো জীবন প্রদীপ নিভে গেছেকিন্তু শত বছর মিয়া ভাইয়ের এই কাজগুলো বেঁচে থাকবে।

 

সতীর্থদের কীভাবে দেখতেন?

খান আতা বলতে ফারুক ছিলেন অন্ধ। প্রায়ই বলতেনবাবার পরে তার স্থান ছিল সবার আগে। আর রাজ্জাক ভাইকে তিনি যে সম্মান করতেনতা সত্যিই অতুলনীয়। বাদল খন্দকারের ‘পৃথিবী তোমার আমার (১৯৯৮)’ সিনেমায় তিনি আর রাজ্জাক ভাই একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন।

 

১৯৯৮ সালের কথা। এফডিসি’র কড়ইতলায় এই ছবির শুটিং সেট ছিল। একদিন দেখলামখাবার নিয়ে বসে আছেন। রাজ্জাক ভাই তখনো শুটিং করছেন। তার দৃশ্যায়ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফারুক দুপুরের খাবার মুখে তোলেননি।

 

আলমগীর ভাইকে দেখতেন ভাইয়ের মতো। একদা বলছিলেনআলমগীরকে কেউ কটু বলা মানে সেটি আমাকে বলা।’

 

নারী অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে মন্তব্য করতে বলেছিলাম। মিয়া ভাই শাবানা-ববিতা-কবরী আপা এই তিনজনকে নিয়ে এত সুন্দর করে নিখুঁত মূল্যায়ন করলেন যেতা এক কথায় ছিল চমৎকার।

 

তবে তাদের মধ্যে কবরীকে ফারুক সবসময় এগিয়ে রেখেছিলেন। বলতেনশিল্পীর কোনো জাত নেইকোনো রং নেই। শিল্পীরা কাদামাটি। তাদের কাজ মূল্যায়ন করার জন্য বারবার আহ্বান জানাতেন সংবাদকর্মীদের।

 

ফারুক নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে অভিনয় করতেন। সালমান শাহ-শাকিল খান-শাকিব খান-রিয়াজ-শাবনূর-পূর্ণিমা-পপি সবার সাথে অভিনয় করেছেন।

 

ফারুক সেটে থাকা মানেই ছিল পরিচালকদের চিন্তামুক্ত থাকা। সব শিল্পীরা সময়মতো শুটিং সেটে হাজির হতেন। মেকাপ রুমে থাকতো না কোনো টুঁ শব্দছিল না চিৎকার চেঁচামেচি। ভয়ে নয়তার প্রতি সম্মান জানিয়েই জুনিয়র শিল্পীরা এই নিয়মগুলো মেনে চলতেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মিশে যেতেন একদম সহকর্মীর মতো। শুটিংয়ের অবসরে আড্ডা আর খোশ গল্পে যেভাবে মেতে উঠতেনতা এখন কে করবে মিয়া ভাই? 

 

এফডিসিতে মাঝে মধ্যে প্রযোজক বা পরিচালকের সঙ্গে শিল্পীদের বিবাদ হতো। তার উপস্থিতি মানে অন্যায্য কথা বলার দুঃসাহস আর কেউ দেখাতো না। এই অভাব এখন কে পূরণ করবে?

 

সমাপ্তির পথে...

বাংলা চলচ্চিত্র দশ বছরে বড় দুঃসময় পার করছে। একের পর এক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যৌথ প্রযোজনা নিয়ে সমস্যাভারতীয় সিনেমা আমদানি নিয়ে সমস্যাএক সমিতি অন্য এক সমিতিকে বয়কট করছে—এই সময় হাল ধরলেন ফারুক আর আলমগীর। তারা দুই ভাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিন নেই রাত নেই একটার পর একটা সমস্যার সমাধান করেছেন।

 

দুষ্টের দমন নীতিতে থেকেছেন অবিচল। এক সময় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। জাতীয় সংসদে নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষদের প্রয়োজনের কথা বলতে গিয়ে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের কথা বলতে ভোলেননি। নানা রকম আবদার তুলেছেন। অনেক সুফলও আসতে শুরু করে।

 

এই নায়ক করোনাকাল শুরুর কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকে বাংলা সিনেমার একাত্মতার বন্ধনগুলো নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। নানারকম পটপরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে। অনেকেই আশা করেছিলেনতিনি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে এসে অতীতের মতো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেনসবাইকে আবার এক ছাতায় ছায়াতলে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তা আর হলো না।

 

আর কোনোদিন এফডিসিতে তার পদচারণা থাকবে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন ফ্লোরগুলোয় হয়তো লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন দেখা বা শোনা যাবে কিন্তু তাকে আর দেখা যাবে না। আর মিয়া ভাইয়ের সেই সুন্দর হাসিটা কেউ দেখবে না। অভিমানী সেই কণ্ঠস্বর আর কেউ শুনবে না। সমাপ্তি হলো চির সবুজ অভিনেতার পথচলা। বিদায় নিলেন এক অনন্য অভিভাবক। একইসঙ্গে আর গর্জে উঠবে না অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকা এক মিয়া ভাইয়ের কণ্ঠস্বর...। 

 

কামরুজ্জামান বাবু ।। সিনিয়র সাংবাদিকসাবেক সাধারণ সম্পাদকবাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি

Side banner