ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
৭ই মার্চের ভাষনঃ

প্রেক্ষাপট, তাৎপর্য, তাত্তিক ও প্রায়োগিক বিশ্লেষন

ভোরের মালঞ্চ | আরিফুর রহমান মার্চ ৭, ২০২৪, ১২:০৮ এএম প্রেক্ষাপট, তাৎপর্য, তাত্তিক ও প্রায়োগিক বিশ্লেষন
আরিফুর রহমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (সিনিয়র সহকারী সচিব) সদর, লক্ষ্মীপুর ।

বঙ্গবন্ধু বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে ভাষণ শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। উক্ত ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়। ১৩টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। ১৩ তম হিসাবে মাহাতো নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর কুড়মালি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়, যা নৃ তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষায় ১ম অনুবাদ।


৪৮, ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০ এবং সবশেষে ১৯৭১ – এই ২৩ বছর ধরে মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। এসময়ে দীর্ঘ ও প্রলম্বিত সংগ্রাম – কখনও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কখনও ছাত্রদের বিজ্ঞানভিত্তিক, সার্বজনিন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, কখনও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা স্বায়ত্বশাসন আদায়ের জন্য সংগ্রাম। কখনও বা সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, কখনও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম– এ সব রক্তঝরা বেগবান আন্দোলন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এক মহাজাগরণের – যার ঢেউ শীর্ষ বিন্দু ছুঁয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চ মাসে।


১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে  ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণা দেন। ঘোষণার মর্মকথা ছিল একটাই: পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা। ইয়াহিয়া খানের এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটটি ছিল এমন: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫১টি আসন। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ৩৮.৩% মানুষের সমর্থন নিয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯.৫% ভোট জনসমর্থন নিয়ে জয়লাভ করে ৮১টি আসনে। জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের পরিষ্কার সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেন। তার প্রতিফলন ঘটে তার ১লা মার্চের ঘোষণায়। তিনি বলেন :
“The position briefly is that the major party of West Pakistan, namely, the Pakistan People’s Party, as well as certain other political parties, have declared their intenton not to attend the National Assembly session on the third of March, 1971. In addition, the general situation of tension created by India has further complicted the whole position. I have, therefore, decided to postpone the summoning of the National Assembly to a later date” স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা ইয়াহিয়া খানের বেতার ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা ব্যাপক আকারে এবং স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ঢাকার ফার্মগেট, এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন জায়গায় নিরস্ত্র মানুষের মিছিলে গুলি চালানো হয়। আবারো রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। আন্দোলন আর অহিংস অসহযোগে সীমাবদ্ধ থাকে না। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় দুপুর ১২.৪৫ মিনিটে। সেই সমাবেশেই বাংলাদেশের পতাকা প্রথমবারের মত ছাত্র-জনতার সামনে প্রদর্শিত হয়।


ইয়াহিয়া খান ৬ই মার্চে বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের লক্ষে ১০ই মার্চ ঢাকায় একটি গোল টেবিল বৈঠক আয়োজনের কথা জানান এবং ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। তবে ভাষণের শেষভাগে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন,


“Finally let me make it absolutely clear that no matter what happens, as long as I am in command of the Pakistan armed Forces and Head of the State, I will ensure complete and absolute integrity of Pakistan. I will not allow a handful of people to destroy the homeland of millions of innocent Pakistanis. It is the duty of the Pakistan Armed Forces to ensure the integrity, solidarity and security of Pakistan, a duty in which they have never failed.”


ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে এই তথ্যটি উহ্য রাখেন যে গত কয়েকদিনে পূর্ব বাংলার ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোরসহ অন্যান্য শহরে পাকিস্তানের ‘integrity, solidarity and security’ রক্ষার নামে পাকিস্তান সশস্র বাহিনী ইতিমধ্যেই বহু নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শোনার পর বঙ্গবন্ধু অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসেন। আলোচনা শেষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়: “শহীদদের রক্তে রঞ্জিত রাস্তার রক্ত এখনো শুকোয়নি। শহীদদের পবিত্র রক্ত পদদলিত করে ১০ই মার্চ তারিখে প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যোগদান করতে পারে না।”


সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এলো ৭ই মার্চ। সবার দৃষ্টি ৭ই মার্চের দিকে। চিন্তিত পাকিস্তানি সামরিক চক্র কৌশলের আশ্রয় নিল। ৭ই মার্চের এক দিন আগে, অর্থাত্ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তত্কালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের 'Witness to Surrender' গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া তার দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলার চেষ্টা করেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’


বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার ভাববার কী আছে। সারাজীবন তুমি একটা লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছ। জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করেছ। বারবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছ। বিশ্বাসী আত্মা থেকে তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবা। ’ 


বক্তৃতায় তিনি মূলত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে ছিল দুটি পথ। এক. স্বাধীনতা ঘোষণা করা। দুই. পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব না নিয়ে, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত না হয়ে, সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদান করা। তিনি দুটিই করলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন সেদিনের পরিস্থিতি। সেনাবাহিনী তখন প্রস্তুত। মাথার ওপর বোমারু বিমান ও হেলিকপ্টার গানশিপ টহল দিচ্ছে। যখনই বঙ্গবন্ধু এই ভাষায় বলবেন যে আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, তখনই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করবে। সে জন্য বঙ্গবন্ধু সব কিছু জেনেই বক্তৃতা করেছেন। এত বিচক্ষণ নেতা ছিলেন যে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সামরিক শাসকের উদ্দেশে চারটি শর্ত আরোপ করলেন-মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করো, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নাও, এ কয়দিনে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করো এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো। এই চারটি শর্ত আরোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন না। পাকিস্তানিরা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায় আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সদাসতর্ক ও সচেতন। অন্যদিকে পুরো বক্তৃতাটি জুড়ে ছিল আসন্ন জনযুদ্ধের রণকৌশল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। ”


বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্তু একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো৷''- এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷


আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পূর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগের এক বিস্ময়কর ঘটনা। যোগাযোগ বিষয়ে আধুনিক নিয়ম-কানুনের এক আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণে।
প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এই কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। সম্প্রচার তত্ত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। এক হাজার একশত সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোন বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোন বাহুল্য নেই- আছে শুধু সারকথা, সারমর্ম। তবে দু’-একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে।

 

ভাষণের সূচনাপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে 'There is nothing like a good beginning for a speech'। বক্তব্যের প্রারম্ভে শ্রোতার মানসিক অবস্থান (audience orientation) ও সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক বলে যোগাযোগ তত্ত্বে যা বলা হয় (reference to audience and reference to recent happenings) তার আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটে বঙ্গবন্ধুর এই যুগান্তকারী ভাষণে।

 

বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবাই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ অত্যন্ত কার্যকর বক্তৃতার অবতরণিকা-যা পুরো বক্তৃতার মূল ভিত্তি তৈরি করেছে ও শ্রোতৃকূলকে অভ্যুদিত বক্তৃতার আভাস দিচ্ছে।

 

জনযোগাযোগে যেসব speech idiom ব্যবহার করার কথা তা অত্যন্ত সঠিকভাবে সুপ্রযুক্ত হয়েছে এই বক্তৃতায়। শ্রোতাকে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে তিনি সংলাপের বাচনশৈলী অনুসরণ করেছিলেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। বক্তৃতার বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সরাসরি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন পাঁচটি। ‘কি অন্যায় করেছিলাম? কি পেলাম আমরা? কিসের আর-টি-সি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?” বক্তার সাথে শ্রোতার মেলবন্ধন সৃষ্টিতে 'ask question and then answer' পরামর্শের সুপ্রয়োগ ঘটেছে এ ভাষণে। পুরো ভাষণে বর্তমান কালের যৌক্তিক ব্যবহার বক্তৃতাটিকে সজীবতা দিয়েছে। আবার কথোপকথনের ধারার স্বার্থে তিনি অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের সুন্দর সংমিশ্রণও ঘটিয়েছেন এই বক্তৃতায়।

 

বক্তৃতার যেসব অংশে বঙ্গবন্ধু আদেশ, নির্দেশ বা সতর্ক সঙ্কেত দিচ্ছেন সেসব স্থানে বাক্যগুলো স্বাভাবিকভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। বহু গবেষণার পর যোগাযোগ তাত্ত্বিকদের declarative বাক্য সংক্ষিপ্ত করার বর্তমান নির্দেশিকা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যথাযথ প্রতিফলিত। ভাষণ থেকে কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন, “২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। সরকারি কর্মচারীদের বলি: আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল। কেউ দেবে না।”

 

রাষ্ট্রনায়কোচিত ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক বক্তৃতার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ কর্মোদ্যোগ, কর্মপরিকল্পনার সাথে শ্রোতাদের শুধু পরিচিত করানোই নয়, বরং তাদেরকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা। বঙ্গবন্ধু কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে সাধন করেছিলেন তাঁর এ বক্তৃতার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর প্রোৎসাহনমূলক বক্তব্য- “তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল: প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।” সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এই বক্তব্যকেই হুকুমনামারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাদেশ বলে সেদিন গ্রহণ করেছিল। 

 

মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্গবন্ধু চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণের সময়ও তাঁর মানবিক উদারতার কোন হেরফের কখনও যে ঘটেনি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ৭ই মার্চের ভাষণ। রাষ্ট্রের জন্মমৃত্যুর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়েও তিনি “আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব” বলার সাথে সাথেই আবার আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করেন- “তোমরা আমার ভাই-তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপরে গুলি চালাবার চেষ্টা কর না।” কঠিনের সাথে কোমলের এমন সহাবস্থান উদার-হৃদয় বঙ্গবন্ধুর মাঝে সর্বদাই বিদ্যমান ছিল।

 

যথাযথ তথ্যচয়নের ফলে বক্তৃতাটি অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ হয়েছে, আর তীক্ষ্ণ যুক্তিবিন্যাসের কারণে শ্রোতাদের মাঝে তীব্র প্রণোদনা সঞ্চারে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়- “যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য-আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-আর্ত মানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।” সহজ ভাষায় এ ধরনের জোরালো যুক্তিবাদ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এক সহজাত বিশেষত্ব। 

 

বক্তব্যের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য বক্তৃতার মাঝামাঝি এসে সূচনা বক্তব্যের সম্প্রসারণ বা পুনরাবৃত্তির কথা বলা হয় আজকাল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আশ্চর্যরকমভাবে এ দিকটিও প্রতিভাসিত। যখন তিনি বক্তৃতার মাঝামাঝি এসে বলেন, “তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।”

 

অন্যের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে গেলেও বঙ্গবন্ধু 'put up the attribution first'-এর নিয়মনীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন। বক্তার নাম প্রথম উল্লেখ করে তারপর তার মন্তব্য/বক্তব্য উত্থাপন করেছেন। যেমন- “ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না” কিংবা “ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন। তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম” ইত্যাদি। 

 

সর্বজনীন ভাষণের একটি প্রধান দায়িত্ব কর্মসূচি নির্ধারণ (agenda setting function), যা বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে এসেছে বার বার। কিন্তু কঠোর কর্মসূচি প্রদান কালেও বঙ্গবন্ধুর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির (humanistic approach) যে কোন তারতম্য ঘটত না-তার স্বাক্ষর নিম্নোক্ত বক্তব্য : “ আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, ফৌজদারি, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো-ওয়াপদা, কোন কিছু চলবে না।

 

public address /জনযোগাযোগে ব্যক্তি বা ঘটনার মর্যাদা আরোপন (status conferral function) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার বিভিন্ন অংশে এই বিধানের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেমন, তিনি বলছেন- “আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছিয়ে দেবেন” কিংবা “আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যতদূর পারি ওদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব।”

 

সর্বজনীন বক্তব্যে ও জনযোগাযোগে কার্যকর ফল লাভের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্থাপনের (posing a challenge) প্রয়োজনীয়তা সর্বজনবিদিত একটি পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে এসে যখন বলেন, “প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিতে শিখেছি, রক্ত আরও দেব- এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ”- তখন বোঝা যায় যে তিনি যোগাযোগ বিদ্যার শিল্পকুশল প্রণালীতে পরম দক্ষতার সাথে কিভাবে শ্রোতাদেরকে বক্তৃতার সাথে গেঁথে ফেলেছেন।

 

যে কোন বক্তৃতার সংজ্ঞা নির্ধারণী অংশ সাধারণত শেষেই উচ্চারিত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে যোগাযোগবিদদের আধুনিক অভিমত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শেষ বাক্য “এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম।” অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ে ব্যক্ত স্বাধীনতার কার্যত ঘোষণা-যা ৭ মার্চের বক্তৃতার সংজ্ঞা হিসাবে স্বীকৃত। যে প্রক্রিয়ায় তিনি ভাষণ শেষ করেছেন তা যোগাযোগবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকের সাথে হুবহু মিলে যায়। যেখানে বলা হয় 'Don't drag out your conclusion'। আমরা প্রায়ই ‘পরিশেষে বলছি’, ‘একটি কথা বলেই শেষ করছি’ বা ‘পরিশেষে এ কথাটি না বললেই নয়’ ইত্যাদি ভূমিকা করে বক্তব্য শেষ করি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি speech definition-এ প্রবেশ করেছেন- যা আধুনিক তত্ত্বের যথাযথ প্রয়োগ এবং যা ছিল ৫০ বছর পূর্বে অকল্পনীয়।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪০ সালের ৪ঠা জুন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন,
We shall fight on the beaches, we shall fight on the landing grounds, we shall fight in the fields and in the streets, we shall fight in the hills, we shall never wurrender.
এখানে 'We shall fight' ছিল বক্তৃতার সংজ্ঞা।


একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালের ২৮শে আগস্ট যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার সংজ্ঞা অংশ ছিল 'I have a dream'।
এই ঐতিহাসিক ভাষণে speech definition “এবারের সংগ্রাম-আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম।”


আমাদের প্রাত্যহিক চিন্তা-চেতনা ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিশীলিত ও স্বচ্ছ উপস্থাপনা সার্বজনিক সম্ভাষণ বা public address -এর অন্যতম শর্ত।
এ প্রসঙ্গে ডেল কার্নেগীর উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, 'The best argument is that which seems merely an explanation' অর্থাৎ সর্বোত্তম যুক্তি হচ্ছে শুধুই সঠিক ব্যাখ্যা। তৎসময়ের ঘটনাবলীর আনুপূর্বিক প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা এই ভাষণটিকে সব সময়ের জন্য যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলেছে।

 

বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় শব্দের ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনের (১৭৪৩-১৮২৬) বিখ্যাত উক্তি 'the most valuable of all talents is that of never using two words when one will do' আমাদের স্মরণে আসে। সাত মার্চ একাত্তরের এই ভাষণ বাংলা ভাষায় শুধু শ্রেষ্ঠ ভাষণ নয়, পৃথিবীর এটি একটি অনন্যতম ভাষণ। কারণ এ ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।

 

সাত মার্চের ঐতিহাসিক অভিভাষণ বঙ্গবন্ধুর extempore speech হলেও লক্ষণীয় যে উপস্থিত বক্তৃতার সচরাচর পরিদৃষ্ট লক্ষণ যেমন বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি, শব্দ চয়নে মুহূর্তের দ্বিধাগ্রস্ততা ইত্যাদি ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে কোন টীকা বা নোট ব্যতিরেকে ছেদহীনভাবে এমন নির্মেহ ও নির্দেশনামূলক ও একই সাথে কাব্যময় বক্তৃতা প্রদান একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব বিধায় আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজ উইক তখনই বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল একাত্তরের ৫ই এপ্রিলে প্রকাশিত তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধে।


২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে "ডকুমেন্টারি হেরিটেজ" (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটি সহ মোট ৭৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসাথে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাছাড়া ইউনেস্কো পুরো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে সংরক্ষিত করে থাকে। ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) ’ ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭ টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।

 
Jacob F Field তার বই “We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History” তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। যেখানে “সিসেরো থেকে চার্চিল, লিঙ্কন থেকে মাও” পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের বিখ্যাত ভাষণ একসাথে সংকলন করা হয়েছে।


৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে ‘ইতিহাসের প্রতিশোধ’ হিসেবে তুলনা করেছেন। কারণ স্বাধীন দেশে দীর্ঘসময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।
"শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই সতর্ক কৌশলের কারণে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি।”- তোফায়েল আহমেদ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আইএসআই (Inter Service Intellegence) এর ৮ই মার্চ এর প্রতিবেদনে বলা হয় “Bangabandhu cleverly delivered his speech. He didn’t take the responsibility of breaking up Pakistan, but declared independence, as well as imposed four conditions without being identified as a separatist. We had nothing to do except stand aside and play silent listeners. We have failed to take action as planned”
৭ মার্চের ভাষণের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর সেগুলো হলো: ১.বাঙালির সংগ্রাম ঐহিত্য এবং বঞ্চনার ইতিহাস, ২. গণতান্ত্রিক চেতনা, ৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ৪. শান্তির বাণী, ৫. মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ৬. আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ৷


৭ মার্চের ভাষণকে একটি উৎকৃষ্টমানের কবিতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধুর সংযত আবেগ, মাপা বাক্য ব্যবহার, উচ্চারণের বলিষ্ঠতা, যুক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদির দিকে তাকালে বোঝা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে ইতিহাস রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু, তা এ জাতির উত্থানপর্বের সুমহান প্রকাশ।

 

লেখক: আরিফুর রহমান

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী সচিব), সদর, লক্ষ্মীপুর।


 

Side banner