ঢাকা সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা ভাষায় লক্ষ্মীপুরের তোয়াহা ও নূরীর অবদান অনস্বীকার্য

ভোরের মালঞ্চ | ফরহাদ হোসেন ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩, ০৩:২৬ পিএম বাংলা ভাষায় লক্ষ্মীপুরের তোয়াহা ও নূরীর অবদান অনস্বীকার্য

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের এই ভাষা কেড়ে নেওয়ার জন্য কতো জল্পনা-কল্পনা করেছে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী। তারা ‘একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ করার ঘোষনা দিয়েছেন। তবে সেটি মেনে নেয়নি বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে পোস্টার, লিপলেট, মিছিল, মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দীর্ঘসময় চালিয়ে গিয়েছেন আন্দোলন। 


রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে ভাষা সংগ্রামীদের মিছিলের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। শহীদ হন সালাম, জব্বার, বরকত ও রফিকসহ নাম না জানা অনেকেই।  


মায়ের ভাষাকে রক্ষার এমন বিরল দৃষ্টান্ত’র জন্য ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। পরবর্তীতে ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশ সমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। এর আগে বাংলাদেশে দিনটিকে শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা হতো।  

 
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অবশেষে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে ও বিশ^ দরবারে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করে। যাদের বলিষ্ঠ নের্তৃত্ব ও সাহসিকতায় সেদিন ভাষা আন্দোলনের সফলতা লাভ করেছিল, তাদের মধ্যে লক্ষ্মীপুরের কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা ও সানা উল্ল্যাহ নুরী অন্যতম। সানাউল্লাহ নূরী একাধারে একজন সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক ছিলেন। আর কমরেড তোয়াহা ভাষা আন্দোলনের পরবর্তীতে মহান মুক্তিযোদ্ধেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন। 

 

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে মোহাম্মদ তোয়াহা ও সানাউল্লাহ নূরীর ভাষা আন্দোলন সহ মুক্তিযুদ্ধের নানা অবদান তুলে ধরা হলো : 

 

মোহাম্মদ তোয়াহা : 

মোহাম্মদ তোয়াহা ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী এবং রাজনীতিবিদ। এই আন্দোলনের সময় তাকে অন্যমত একজন ছাত্র নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হতো। মোহাম্মদ তোয়াহা লক্ষ্মীপুর জেলার কুশাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও পরবতীতে তাদের পরিবার এখনকার কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট এলাকায় স্থান্তরিত হয়।


তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৩৯ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। পরে ১৯৪৮ সালে তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে তিনি এমএ সম্পনন করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসে সে সময়ের মঙ্গার বিরুদ্ধে নামতেই তিনি রাজনীতিতে আসেন।


তিনি ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি অধিকাংশ পোষ্টার, নিবন্ধ, লিফলেট তৈরী করেছিলেন। ১১ মার্চ, ১৯৪৮ তারিখে যখন তোয়াহার নেতৃত্বে একটি দল সচিবালয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিতে যায় তখন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করা। পরে তিনি তাদের দ্বারা নির্যাতন হন এবং অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে তাকে হাসপাতালে একটা সপ্তাহ থাকতে ছিল হয়েছিল।


রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি এর একজন নেতা হিসেবে, তোয়াহা সরকারের সাথে সকল ধরনের বৈঠকে অংশ নিতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের ভিপি ছিলেন। যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেখানে এসেছিলেন, তোয়াহা তাকে তাদের ভাষা চাহিদা সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি পেশ করেছিলেন।


সরকার যখন আরবি স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে বাংলা লেখার জন্য প্রচারনা চালাচছিল তখন তনি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদে তিনি যুব লীগের সংবাদদাতা ছিলেন। ১৯৫২ সালের শেষের দিকে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।


তিনি দুই বছর পরে মুক্তি পান এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রন করেছিলেন যেখানে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়েছিল। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন ।


১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় রামগতি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন। মেহাম্মদ তোয়াহা “পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম. এল.) নাম ত্যাগ করে শুধু কমিউনিষ্ট পার্টি (এমএল) নাম নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তারা মুক্তিযুদ্ধে বা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য বাম দল ও গ্রুপের সমন্বয়ে “বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মা. লে.) গঠন করেন।


২৯ নভেম্বর ১৯৮৭ সালে মোহাম্মদ তোয়াহা মারা যান। সাবেক রামগতি বর্তমান কমলনগর উপজেলা সদর হাজিরহাটে তার সমাধি রয়েছে ।

 

সানাউল্লাহ নূরী : 

তিনি ছিলেন, একাধারে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। ১৯২৮ সালের ২৮ মে লক্ষ্মীপুর জেলার অবিভক্ত রামগতি বর্তমান কমলনগর উপজেলার চর ফলকন গ্রামে তাঁর জন্ম। দারুচিনি দ্বীপের দেশ, ভ্রমনকাহিনী, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, কবিতাসহ অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থের লেখক ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় তিনি বামছাত্র রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ঢাকা কলেজের নুরপুর ভিলা ছাত্রাবাসে “রাট্রভাষা বাংলা না উর্দু” নামক সেমিনারে তিনি যোগ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো আওয়াজ তোলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের মূখপত্র “অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ইহসানের” সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ পত্রিকাটি মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। 


তাঁর শৈশব শিক্ষা শুরু হয় লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার হাজিরহাট জুনিয়র অ্যাংলো ইংলিশ অ্যারাবিক মাদরাসায়। এরপর তিনি সাবেক নেত্রকোণা জেলার ময়মনসিংহ স্কুলে ভরতি হয়ে শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।


সানাউল্লাহ নূরী ১৯৯৪ সালে যোগদানের পর ১৯৯৭ সালের মে মাস পর্যন্ত দৈনিক দিনকালের সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে দৈনিক জনতা (১৯৮৭) সম্পাদক, নিবাহী সম্পাদক দৈনিক দেশ (১৯৭৮), দৈনিক কিশোর বাংলা, নিবাহী সম্পাদক দৈনিক গনবাংলা (১৯৭২), দৈনিক বাংলা, দৈনিক পাকিস্তানের (১৯৫২) বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে দৈনিক ইত্তেফাক , ১৯৬০ সালে মাসিক সওগাত পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সানাউল্লাহ নূরী। ১৯৪৮ সালে দৈনিক আজাদ এবং ১৯৫২ সালে দৈনিক আজাদ ছেড়ে দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দিয়ে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত সংবাদে থাকেন। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের মূখপত্র “অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা ইহসানের” সহযোগী সম্পাদকের দায়িত্বের মধ্য দিয়ে শুরু করা সাংবাদিকতা দিয়ে তিনি টানা ৫০ বছর সাংবাদিকতা করেন।


১৯৮৮ সালে গঠিত “বাংলাদেশ কাউন্সিল অব এডিটরস” এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সানা উল্লাহ নূরী। তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় কৃতিত্বের জন্য একুশের রাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদক পান। ১৯৯৩ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্মৃতি পরিষদের শিল্পাচার্য পদক পান। ১৯৯৫ সালে পশ্চিম বাংলার “ড: দীনেশ চন্দ্র সেন গবেষণা পরিষদ” প্রদত্ত দীনেশ সেন স্বর্ন পদকে ভূষিত হন। 


সানাউল্লাহ নূরী ৮টি উপন্যাস, ৭টি গল্প ও শিশুতোষ গ্রন্থ, ৩টি ভ্রমণ কাহিনী, ৪টি ঐতিহাসিক গ্রন্থ, সাংবাদিকতা বিষয়ে ২টি গ্রন্থ, রাজনৈতিক বিষয়ে ২টি গ্রন্থ, ২টি কাব্য গ্রন্থসহ ৬০টি গ্রন্থ রচনা করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হচ্ছে: আন্দার মানিকের রাজকন্যা, নিঝুম দ্বীপের উপাখ্যান, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতা, নোয়াখালী-ভুলুয়ার ইতিহাস ও সভ্যতা, উপমহাদেশের শত বর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধ। 


১৯৯৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি দৈনিক দিনকালের সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করার সময অসুস্থতার কারণে জন্য দিনকাল এবং সাংবাদিকতা থেকে অবসর নেন সানাউল্লাহ নূরী। ২০০১ সালের ১৬ জুন ৭৩ বছরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একই বছর ১৮ জুন ঢাকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
 

Side banner