সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের জীবনের এক বিস্ময়কর অধ্যায় আবার সামনে এলো। নতুন একটি তথ্যচিত্রে প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে দেখানো হয় ১৯৭৩ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি ১৪০ জনের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।
বুধবার মোহাম্মদ বিন রশিদ লিডারশিপ ফোরামে প্রদর্শিত তথ্যচিত্রটির নাম— ‘দ্য নেগোশিয়েটর: মোহাম্মদ বিন রশিদ’। এতে উঠে এসেছে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা এবং শেখ মোহাম্মদের সাহসী ভূমিকা। এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গালফ নিউজ।
১৯৭৩ সালের জুলাই। জাপান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৪০৪ ছিনতাই হয়। আমস্টারডাম থেকে উড্ডয়ন করা বোয়িং ৭৪৭-এ ছিলেন ১২৩ জন যাত্রী ও ২২ জন ক্রু। পাঁচজন সন্ত্রাসী বিমানে ছিলেন। তারা ছিল পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন এবং জাপানিজ রেড আর্মির সদস্য।
তাদের দাবি ছিল—ইসরায়েলে আটক সন্ত্রাসী কোজো ওকামোটোর মুক্তি। বিভিন্ন দেশ বিমান নামানোর অনুমতি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে উড়োজাহাজটি। তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন শেখ মোহাম্মদ।
তথ্যচিত্রে বলা হয়, ২৪ বছর বয়সী শেখ মোহাম্মদের কাঁধেই চাপানো হয় এই আন্তর্জাতিক সংকট সমাধানের দায়িত্ব। সন্ত্রাসীরা হুমকি দেয়—প্রতি ঘণ্টায় একজন যাত্রীকে হত্যা করা হবে।
সংকটকালে এক নারী সন্ত্রাসী ভুলবশত গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটান। এতে তিনি নিহত হন। যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
তবু শেখ মোহাম্মদ শান্ত থাকেন। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যান সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে উপস্থিত সাংবাদিক অ্যাঞ্জেলিনো স্কিন্তু বলেন, ‘যাত্রীদের পরিবার শেখ মোহাম্মদকে তখন একমাত্র ভরসা হিসেবে দেখছিল।’
কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই শেখ মোহাম্মদ অনন্য কৌশল প্রয়োগ করেন। তিনি সন্ত্রাসীদের মানবিকতার দোহাই দেন। যাত্রীদের জন্য খাবার ও পানীয় পাঠান। বিমানের এয়ার কন্ডিশনার চালু রাখতে জ্বালানি দেওয়ার অনুমতি দেন।
এমনকি তিনি মানসিক চাপও তৈরি করেন। হেলিকপ্টার ও গাড়ি দিয়ে রানওয়ের চারপাশে টহল বাড়ান। এতে সন্ত্রাসীরা অস্বস্তি বোধ করে। ধীরে ধীরে তারা তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করে।
ব্রিটিশ কাউন্টার টেরোরিজম কমান্ডের সাবেক প্রধান ফিলিপ উইলিয়ামস বলেন, ‘তার ধৈর্য ও কৌশলে সন্ত্রাসীরা মুগ্ধ হয়েছিল। এভাবেই যাত্রীদের মুক্তির পথ তৈরি হয়।’
ধাপে ধাপে আলোচনার মাধ্যমে শেখ মোহাম্মদ কয়েকজন যাত্রীকে মুক্ত করাতে সক্ষম হন। সন্ত্রাসীরা স্বীকার করে—প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আন্তরিকতা ও সহানুভূতির কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ৮০ ঘণ্টার টানটান উত্তেজনার পর তারা বিমানের গন্তব্য পরিবর্তনে রাজি হয়। শেখ মোহাম্মদ তাদের বুঝিয়ে বলেন, দুবাইয়ে কোনো সমাধান নেই। অবশেষে বিমানটি লিবিয়ার বেনগাজির উদ্দেশে উড্ডয়ন করে।
বেনগাজি পৌঁছে ২৩ জুলাই সব যাত্রী ও ক্রুদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর ছিনতাইকারীরা বিমানে বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে ততক্ষণে সবাই নিরাপদ।
সাক্ষীরা বলেন, ‘যাত্রীরা নেমে যাওয়ার মাত্র ১০ মিনিট পরই পুরো বিমান উড়ে যায়।’
এই সংকট সমাধানে শেখ মোহাম্মদ আন্তর্জাতিক প্রশংসা পান। জাপানের তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স আকিহিতো ব্যক্তিগত চিঠিতে কৃতজ্ঞতা জানান। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিচি মিয়াজাওয়াও আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানান।
এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তার নেতৃত্বগুণকে আরও সমৃদ্ধ করে। ১৯৭৭ সালের লুফথানসা ফ্লাইট ১৮১ এবং ১৯৮৪ সালের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৪২১ ছিনতাই মোকাবিলায়ও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আপনার মতামত লিখুন :