পল্লী চিকিৎসা ও সাংবাদিকতা এটাই ছিল আশরাফ উদ্দিনের মূল পেশা। নদীভাঙন রোধ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে ছুঁয়ে যেত, তাই ভাবলেন চেয়ারম্যান হয়ে জনগণকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেবেন। এই চিন্তা থেকেই রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি।
সাইকেল চালিয়ে, হাতে মাইক নিয়ে এলাকার অলিগলিতে চালিয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণা। তার কোনো পেশাদার এজেন্ট ছিল না। গ্রামের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, জেলেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার হয়ে প্রচারে অংশ নেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে। দায়িত্বে এসেই ভাঙতে শুরু করেন প্রচলিত ধ্যান-ধারণা। অল্প সময়েই হয়ে উঠেন ‘গরীবের বন্ধু’ এবং ‘জনবান্ধব চেয়ারম্যান’।
স্থানীয়রা জানান, আশরাফের হাতে সবসময় একটি ব্যাগ থাকত। ওই ব্যাগে থাকত ইউনিয়ন পরিষদের সিল ও প্যাড। তিনি মানুষের দরজায় দরজায় গিয়ে পরিষেবার কাজ করে দিতেন। রাস্তাঘাট, হাটবাজার যেখানেই তাকে পাওয়া যেত, সেখানেই কাজ হতো। তার সততা ও নিষ্ঠা অল্প সময়েই সারা জেলায় প্রশংসিত হয়। ২০১৫ সালে তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। যদিও তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন না, তবে বিএনপির প্রতি তার সমর্থন ছিল।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তার একমাত্র ছেলে নানার বাড়িতে থাকছে। সংসারের অভাব সহ্য করতে না পেরে তার স্ত্রী সন্তানকে রেখে চলে গেছেন। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার বাবা-মা।
আশরাফ উদ্দিন জানান, জীবনের কঠিন সময় পার করছেন তিনি। বর্তমানে বরগুনায় একটি এনজিওতে সামান্য বেতনে কাজ করেন। মামলার হাজিরা দিতে তাকে বারবার বরগুনা থেকে নোয়াখালী যেতে হয় যাত্রাপথ প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার। এখন পর্যন্ত তাকে ৪৪ বার আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। প্রতি বার হাজিরায় খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, একসময়কার সহকর্মী সাংবাদিকের সামনে এসব বলতে গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারেননি।
মেঘনার নদীভাঙন নিয়ে আশরাফ জানান, নদীর পাড় রক্ষায় স্থানীয়দের আশ্বাসে জামিনদার হয়ে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেছিলেন। কিন্তু তিন মাসের মাথায় জোয়ারে বাঁধ ভেঙে যায়। স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়ায় ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই স্থানীয়দের অনুরোধে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে জয়ী হন।
ভিজিএফ চাল বিতরণের বিষয়ে আশরাফ উদ্দিন জানান, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ইউনিয়নের ৬৩০ জন জেলের মাঝে ৩০ কেজি হারে ৭৫.৬ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ পান। ওই সময় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, দুই ভাইস চেয়ারম্যান, নয়জন ইউপি সদস্য, তিনজন নারী সদস্য এবং দুটি জেলে সমিতিসহ আটটি পক্ষ আলাদা আলাদা তালিকা জমা দেয়। এতে প্রাথমিকভাবে কিছু জেলের নাম তালিকায় একাধিকবার উঠে আসে। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তালিকা যাচাই করে সংশোধন করা হয় এবং যথাযথভাবে চাল বিতরণ করা হয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, জনপ্রিয়তা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম খলিল তার বিরুদ্ধে ভিজিএফ চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ তোলে। তিনি থানার ওসি, ইউএনও, বিভাগীয় কর্মকর্তা, এনএসআই, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং দুদকে ২৬টি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
ফলে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ওসি, উপজেলা প্রকৌশলীসহ একাধিক কর্মকর্তা মিলে মোট ১২টি তদন্ত করেন। কিন্তু কোনো তদন্তেই চাল আত্মসাতের প্রমাণ মেলেনি, বরং আশরাফকে নির্দোষ বলা হয়। তারপরও ২০১৪ সালে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম আবারও দুদকে অভিযোগ দেন।
আশরাফ অভিযোগ করেন, দুদকের এক কর্মকর্তা তার কাছে ১৩ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ না দেওয়ায় চার বছর পর ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও ঘুষ দাবি করেছিলেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। নিম্ন আদালতে জামিন অযোগ্য হওয়ায় এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান আশরাফ। শুরু হয় তার দীর্ঘ ফেরারী জীবন।
আশরাফ বলেন, শুধুমাত্র জনগণের আস্থায় নির্বাচিত হয়েই জনপ্রতিনিধি হওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। চেয়ারম্যান হতে হলে দলের ছত্রছায়া, টাকা আর পেশীশক্তি প্রয়োজন। আমি সব হারিয়েছি সংসার, পরিবার, চাকরি, শান্তি কিছুই নেই। অনেক সময় না খেয়ে থেকেছি, দিনের পর দিন হেঁটে চাকরি খুঁজেছি। একটা ছোট এনজিওতে চাকরি করতাম, সেটাও মামলার খরচে শেষ হয়ে গেছে। ছেলেকে পড়াতে পারি না। চিকিৎসার জন্য ওষুধ খেয়েও ঘুম আসে না।
চরফলকন গ্রামের আব্দুস শহিদ বলেন, জনপ্রিয়তা আর বিএনপির প্রতি সমর্থন ছিল বলেই প্রভাবশালীরা তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বানায়। এখন প্রায় এক দশক ধরে তিনি ফেরারী জীবন কাটাচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আরিফ হোসেন, হাসান আলী ও জয়নাল মাঝি জানান, নদীভাঙন রোধে আশরাফ চেয়ারম্যান অনেক ভূমিকা রেখেছিলেন। পরিষদের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের কারণে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গিয়ে বাবা-মার চিকিৎসাও করাতে পারেননি। স্ত্রীও ছেড়ে গেছেন। এমন চেয়ারম্যান আর পাব না।
বৃদ্ধ মালেক মাঝি বলেন, হাতে মাইক নিয়ে সাইকেল চালিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল। নদীর বাঁধে অনেক কষ্ট করেছে। সততার জন্য আজ তাকে ফেরারী জীবন কাটাতে হচ্ছে।
সাংবাদিক ইউছুফ আলী মিঠু বলেন, আশরাফ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রধানের হাত থেকে চ্যানেল আইয়ের কৃষি সাংবাদিকতা পুরস্কার পেয়েছিলেন। চিকিৎসা দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে, ছিলেন নদীভাঙন রোধ আন্দোলনের অগ্রভাগে। সবাই তাকে ‘গরীবের বন্ধু’ বলেই চিনত।
মামলার আইনজীবী মো. আবদুর রহমান জানান, মামলার রায় ২২ সেপ্টেম্বর ঘোষণার কথা রয়েছে। মামলার কোনো সাক্ষী চাল আত্মসাতের কথা বলেননি, এমনকি রাষ্ট্রপক্ষও কোনো প্রমাণ জমা দিতে পারেনি। সাবেক উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, দুদকের দেওয়া তালিকার সঙ্গে তাদের দপ্তরে সংরক্ষিত তালিকার কোনো মিল নেই।
তিনি আরও বলেন, তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যানও আদালতে বলেছেন, দুদকের কোনো কর্মকর্তা তার সঙ্গে দেখা করেননি, কোনো বক্তব্যও নেয়নি। তদন্তে দেওয়া জবানবন্দি তার নয়।
আইনজীবীর আশা, আশরাফ ন্যায়বিচার পাবেন এবং সাজানো মামলায় বেকসুর খালাস পাবেন।
আপনার মতামত লিখুন :